Mustard Oil / সরিষার তেল
সরিষার তেলঃ
ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামবাংলার সাথে মিশে আছে সরিষার তেল। সরিষার তেল আমাদের প্রতিদিনের রান্নার অন্যতম পরিচিত উপাদান। ঔষধি গুনাগুণের জন্য প্রায় ৩০০০ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই উপমহাদেশে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ও ভোজ্য হিসেবে এই তেল ব্যবহার হয়ে আসছে। ভারতবর্ষে বহুদিন আগে থেকে ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষার তেলের ব্যবহার চালু আছে। দু হাজার তিনশ বছর আগে পুন্ড্রবর্ধনে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার জন্য মৌর্য সম্রাট রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ধান, তিল ও সরিষা পুন্ড্রনগরের জনসাধারণকে সরবরাহ করার জন্য স্থানীয় শাসনকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ থেকে ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষার তেলের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।

জেনে নিন সরিষার তেলের উপকারিতাঃ
একসময় গ্রামবাংলার একমাত্র ভোজ্য তেল ছিল সরিষার তেল। কেবল স্বাদের জন্যই নয়, বহুকাল ধরেই সরিষার তেল ব্যবহারের পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। আমাদের শরীরের নানা উপকারে লাগে এই সরিষার তেল। প্রতিদিনের ছোটখাট স্বাস্থ্যগত সমস্যা এড়াতেও এটি ভীষণ কার্যকরী। কর্পোরেট ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে সরিষার তেলের ব্যবহার প্রায় উঠেই গেছে। অথচ সরিষার তেলের রয়েছে বিবিধ উপকারীতা।
• রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
• উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে
• শরীরের কোলেষ্টেরলের মাত্রা কমায়
• হৃদরোগের সম্ভবনা হ্রাস করে
• ওজন কমায়
• ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়
• টিউমারের আশঙ্কা কমে যায়
• মাইগ্রেন ও সাইনোসাইটিসের ব্যাথা কমায়
• আর্থ্রাইটিসের কষ্ট কমায়
• হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়
• ক্ষুধা বৃদ্ধি করে
• ঠান্ডা ও কাশি উপশমে সহায়ক
• শ্বাস কস্টের প্রদাহ কমায়
• কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
• নিদ্রাহীনতা প্রতিরোধক
• প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন
• শুষ্ক ত্বক মসৃণ ও কোমল করে
• ত্বকের তামাটে ভাব দূর করে
• ত্বকের প্রদাহ দূর করে
• ঠোঁট ফাটা রোধ করে
• চুল পাকা রোধ করতে
• চুল পড়া রোধ করে
• চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
• উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে
• প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক
• এন্টিসেপটিক এর কাজ করে
• অ্যালার্জি প্রতিরোধে সাহায্য করে
সরিষার তেলে রয়েছে ১৯২৭ ক্যালরি। এক কাপ তেলে চর্বি থাকে ২১৮ গ্রাম। এই তেলে ওমেগা আলফা ৩, ওমেগা আলফা ৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ই, ডি, এ, কে এবং বি কমপেক্স, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি ব্যাকটিরিয়াল ও অ্যান্টি ফাঙ্গাল উপাদান, বিটা ক্যারোটিন, প্রোটিন, মিনারেল, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, জিংক এবং সেলেনিয়াম সহ আরো অনেক খাদ্য বা পুষ্টি উপাদান রয়েছে।
কেন খাবেন গরুর ঘানিতে ভাঙা সরিষার তেল?
আমাদের দেশ সহ উপমহাদেশে গরুর ঘানিতে ভাঙা সরিষার তেলের ব্যবহার অতি প্রাচীন। সুপ্রাচীনকাল অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ থেকে বছরের বেশি সময় ধরে এই উপমহাদেশে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ও ভোজ্য হিসেবে এই তেল ব্যবহার হয়ে আসছে। এছাড়াও খ্রিষ্টপূর্বে ষষ্ঠ শতকের সংষ্কৃত ব্যাকরণবিদ পানিনি তৈল পেষনে পেষন যন্ত্র হিসেবে ঘানির উল্লেখ করেছেন।
গরু চালিত কাঠের ঘানিতে দেশি(মাঘি) সরিষার তেল ভাঙানো প্রক্রিয়াটি আদি ও সনাতন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ভাঙানো সরিষার তেল, বর্তমানে আমরা যাকে ইংরেজীতে বলছি ‘Extra Virgin Cold Pressed Mustard Oil’ বা কাচ্চি ঘানি সরিষার তেল।
কোল্ড/কুল প্রেসড অয়েল আসলে কী ? যে পদ্ধতিতে কোন প্রকার ক্ষতিকর ক্যামিকেল এবং প্রিজারভেটিভ ব্যবহার না করে, ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রির মধ্যে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে, বাইরে থেকে চাপ প্রয়োগে তেল নিষ্কাশন করা হয়, তাকে কোল্ড/কুল প্রেসড অয়েল বলে।
একমাত্র গরু চালিত কাঠের ঘানিতেই এই পদ্ধতিতে তেল নিষ্কাশন সম্ভব। যেটা মেশিন বা মেশিনের ঘানিতে সম্ভব নয়। কারন মেশিন বা মেশিনের ঘানিতে অতি ঘূর্ণন গতির জন্য উত্তাপের সৃষ্টি হয়। এই উচ্চতাপ তেলবীজের অনুপুষ্টি নষ্ট করে দেয়, সেই সাথে নানা বিষাক্ততার সৃষ্টি করে। উপকারী অনেক উপাদান পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে এই তেলের ঝাঁজ বেশী হয়। অন্যদিকে গরুর ঘানিতে কোন তাপ উৎপন্ন হয়না ফলে এতে ভাঙ্গানো তেলে সকল পুষ্টিগুন অক্ষুণ্ণ থাকে। ঝাঁজ কম হয়, কিন্তু সুঘ্রাণ হয় তীব্র।
গরুর ঘানিতে ভাঙা এবং মেশিনে উৎপাদিত সরিষার তেলের পার্থক্য বুঝতে হলে প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে এই দুই পদ্ধতির উৎপাদন প্রক্রিয়া কিভাবে হয়। গরুর ঘানিতে ভাঙা সরিষার তেল কোল্ড/কুল প্রেসড(স্বাভাবিক তাপমাত্রা) প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হয় যার ফলে সরিষার তেলে একেবারে ন্যাচারাল উপাদান পাওয়া যায়। যার পুষ্টিগুন শতভাগ থাকে। তবে এই পদ্ধতিতে তৈলবীজের পুরো তেল বের হয় না এবং সময় বেশি লাগে। ফলে তেলের উৎপাদন খরচ বাড়ে। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত তেল প্রায় ১ বছর ভাল থাকে। ছোট ছোট মেশিনে বা বৃহৎ শিল্প কারখানায় উৎপাদিত সরিষার তেল হট প্রেসড(উচ্চ তাপমাত্রা) পদ্ধতিতে তেল উৎপাদন হয়। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত তেলের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায় এবং দেখতে অনেক পরিষ্কার থাকে। অনেকে স্বাদ, গন্ধ, রঙ অটুট রাখার জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল যোগ করে। এই পদ্ধতিতে তৈল বীজের প্রায় পুরো তেলই সংগ্রহ করা যায় ফলে উৎপাদনের সেরাটা পাওয়া যায় এবং উৎপাদন খরচ কম পড়ে। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত তেলের মেয়াদকাল সাধারণত ৪-৬ মাস তবে শিল্প কারখানায় প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল যোগ করে এর মেয়াদ ১ বছর পর্যন্ত বর্ধিত করে। শুধু কি তাই? সরিষার দানার সাথে পানি, ভিনেগার অথবা অন্যান্য তরল মিশিয়ে বানানো হয়। এতে তেল অনেক পাতলা হয়। সরিষার দানায় সিনিগ্রিন (Sinigrin) এবং মাইরোসিনেইস (Myrosinase) নামে দু’টি উপাদান আছে। পানিতে ভিজিয়ে রাখলে এই দু’টি উপাদান বিষাক্ততা সৃষ্টি করে। তাই এই ধরণের তেল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
উপরে উল্লেখিত পুষ্টি উপাদান শতভাগ অটুট থাকে গরুর ঘানিতে ভাঙা সরিষার তেলে। যেটা মেশিনে ভাঙানো সরিষার তেলে পাওয়া যায় না। তো সিদ্ধান্ত নিন নিত্য প্রয়োজনে কোন তেল ব্যবহার করবেন,গরু চালিত কাঠের ঘানিতে ভাঙা সরিষার তেল নাকি মেশিন বা মেশিন চালিত কাঠের ঘানির সরিষার তেল? সিদ্ধান্ত আপনার ...
সতর্কতাঃ
সরিষার তেল ব্যবহারের আগে অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে জেনে নিতে হবে যে, আপনার সরিষার তেল খাঁটি কি না? নকল বা ভেজাল সরিষার তেল ব্যবহারের ফলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি।